প্রত্যয় ইসলাম ডেস্ক: আজ ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো- ‘কোভিড-১৯ : শিশুশ্রম থেকে সন্তানদের রক্ষা করুন, অতীতের চেয়ে অনেক বেশি।’ বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম প্রতিরোধের লক্ষ্যে এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। সত্যি বলতে করোনা মহামারির কারণে বিশ^ মানবতা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
তন্মধ্যে প্রধান দুটি সমস্যা হলো-
১. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অপ্রতুলতা এবং
২. অর্থনৈতিক মন্দা।
এ সমস্যার পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে প্রথমেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। যে কারণে অতীতের চেয়ে শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্বানুভূতি যদি বিশেষ গুরুত্ব না পায় তাহলে গোটা মানবতার ভবিষ্যৎ হুমকির মধ্যে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
একটা চিত্র আমাদেরকে বিষয়টি নিয়ে আরও বেশি ভাবনায় ফেলে দেয়। তাহলো জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রায় দশ শতাংশ শিশু শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। প্রায় ১৫২ মিলিয়ন শিশু যাদের বয়স ৫-৭ বছরের মধ্যে তারা বিভিন্ন রকম শ্রমের সঙ্গে জড়িত এবং তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৭৩ মিলিয়ন) বিপজ্জনক শ্রমের সঙ্গে জড়িত যা মোটেও কাম্য নয়। ইউএনর তথ্য মতে এসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৪৮ শতাংশের বয়স মাত্র ৫-১১ বছরের মধ্যে, ২৮ শতাংশ ১২-১৪ বছরের মধ্যে, ২৪ শতাংশ ১৫-১৭ বছরের মধ্যে। এসব শিশুরা বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত। তন্মধ্যে ৭১ শতাংশ কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ কৃষিনির্ভর দেশগুলোতে শিশুদের শ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তাছাড়া বর্তমান করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় এ হার দ্রুত বেড়ে যাবে বলে নীতিনির্ধারকরা আশঙ্কা করছেন। ফলে, অতীতের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি সচেতনতার পাশাপাশি নতুন নতুন কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ সময়েরও দাবি।
ইসলাম এ ব্যাপারে চমৎকার ও যুগোপযোগী দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামি সমাজে শিশুদের মর্যাদা এবং অবস্থান অনেক ঊর্ধ্বে। পিতা-মাতার প্রতি তারা আমানাত। (আল-কোরআন, সুরা শুরা, আয়াত : ৪৯-৫০)। তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসা ঈমানের সঙ্গে শর্তারোপ করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া যে বিষয়গুলো আলোচনার দাবি রাখে তা হলো- প্রথমত শিশু ও শিশুশ্রমের পরিচিতিতে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে ইসলামের একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান।
যেমন প্রচলিত ধারায় শিশু বলতে ১৮ বছর বয়সের পূর্ব পর্যন্ত ধরা হয়। কিন্তু ইসলামে বালেগ বা পূর্ণ বয়স হওয়ার ক্ষেত্রে শারীরিক কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত। সেটি ৮ বছর থেকে তদূর্ধ্ব যেকোনো বয়সেই হতে পারে। ফলে শিশু হিসেবে এবং শিশুশ্রম হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়স নির্ধারণের ফলে বেশ কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রায়োগিক সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- ১৮ বছর পর্যন্ত যে কাউকে শিশু হিসেবে সাব্যস্ত করলে এবং তাদেরকে যেকোনো কাজ থেকে দূরে রাখলে তা একটি সমাজের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। শর্তসাপেক্ষে তাদের সম্পৃক্ততা অনেক সময় জরুরিও বটে।
দ্বিতীয়ত ঢালাওভাবে শিশুশ্রমকে ইসলাম না বলেনি। বরং শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে পরিভাষাগুলো এক্ষেত্রে অনেক ভারসাম্য এনেছে বলে আমরা মনে করি। যেমন-
১. উমালাহ (কর্মচারী) : এরা এমন কর্মচারী যা অন্যদের মতো। এ অবস্থা তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিকভাবে ক্ষতির মধ্যে ফেলে। এসব কাজের মধ্যে বিভিন্ন শিল্প-কারখানায়, নির্মাণকাজে কিংবা কষ্টসাধ্য কাজে তাদের সম্পৃক্ততাকে বোঝানো হয়েছে। এগুলো কোনো রূপেই বৈধ নয়; হারাম। কারণ, এসব কঠিন কাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সাধ্যাতীত। আর আল্লাহর কর্মপদ্ধতি হলো, কাউকে সাধ্যাতীত কোনো কাজ না দেওয়া। (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
২. তাশগিল (কাজে সম্পৃক্ততা করা) : এটি এমন ধরনের কাজ যাতে তারা সম্পৃক্ত থাকার কারণে অবসর সময়ে অহেতুক সময় নষ্ট না করে উপকারী কিছু কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতে পারে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এটি এক ধরনের প্রশিক্ষণও বলা যেতে পারে। যেমন কোনো সন্তান যদি অবসর সময়ে তার বাবার কৃষিকাজ কিংবা ব্যবসায় সহযোগিতা করে তাহলে এ বিষয়ে সে প্রায়োগিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে আবার অর্থনৈতিকভাবেও উপকৃত হবে। ঠিক অনুরূপভাবে কোনো এতিম বা দরিদ্র, যার বয়স ১৬ কিংবা ১৭ বছর, সেও অন্যদের সঙ্গে এমন কিছু কাজে সম্পৃক্ত হতে পারে, যাতে তার কিছু অর্থনৈতিক উপকারও হয় আবার দক্ষতাও অর্জন হয়।
অন্য একটি পরিভাষা এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তা হলো, ‘খিদমাহ’ যেটিকে আমরা খেদমত করা বলে বুঝি। সন্তান তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের যেকোনো প্রয়োজনে তাদেরকে সেবা-শুশ্রƒষা করতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু উভয় পরিস্থিতিতে ৪টি শর্ত প্রযোজ্য- ১. ইহসান, ২. সুসম্পর্ক, ৩. ন্যায়-পরায়ণতা, ৪. জবাবদিহিতা।
বর্তমান করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাই মিলে একযোগে কাজ না করলে এটি সত্যিই অসম্ভব হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে এসব কিশোর ও যুবকরাও উপরোক্ত শর্তসাপেক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আমাদের বিশ^াস। তাছাড়া ঢালাওভাবে ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সের কিশোর-যুবকদেরকে শ্রম থেকে দূরে রাখলে তাদের অবসর সময়গুলো নানারকম অহেতুক কাজে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে এবং কোয়ারেন্টাইনে বা লকডাউনে থাকার কারণে অফুরন্ত সময় তাদের থাকছে কিন্তু সে অনুযায়ী করার কিছু নেই। ফলে মোবাইল ডিভাইস, টিভি বা সোশ্যাল মিডিয়াতেই সময় নষ্ট করছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এর চেয়ে বরং বাবার সঙ্গে কৃষি কাজে যদি সময় ব্যয় করে কিংবা তার ব্যবসায় সহযোগিতা করে তা কি তাদের জন্যে উপকারী হবে না?